শিল্প বিপ্লব কি? শিল্প বিপ্লব কত সালে সংঘটিত হয় (Industrial Revolution)

✌✌Industrial revolution In which year did the industrial revolution take place?

মূলত যেসব প্রচেষ্টা ও পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে শিল্প যুগের সূচনা হয় তাদের সমষ্টিকেই শিল্প বিপ্লব বলে। এর ফলে কৃষিনির্ভর সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়। পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক জগতেও এর পরিবর্তন ও প্রভাব বিশেষ ভূমিকা রাখে।

শিল্প বিপ্লব মূলত শিল্প এবং বিপ্লব দু’টি পৃথক শব্দের সমষ্টি। যার একত্রে অর্থ দাঁড়ায় শিল্প সংক্রান্ত বিপ্লব। অর্থাৎ কায়িক শ্রমনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তে যন্ত্রনির্ভর উৎপাদন পদ্ধতির আবির্ভাব। উনবিংশ শতাব্দীর বিশ দশকে ফরাসি লেখকরা শিল্প বিপ্লব শব্দটিকে ব্যবহার করেন। ঐতিহাসিক আরনল্ড টয়েনবি (Arnold Toynbee) তাঁর ‘Lectures on the Industrial Revohtion in England-এ শিল্প বিপ্লব ধারণাকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয় মূলত ইংল্যান্ডে যা পরবর্তীতে অতি দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তাই এটিকে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে অভিহিত করা যায় না। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ইংল্যান্ড এবং পরে অন্যান্য দেশে উৎপাদন ব্যবস্থায় যে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে, তার প্রভাবে একটা গোটা যুগের অবসান হয়ে অন্য একটা নতুন যুগের আবির্ভাব ঘটে। ঐতিহাসিক টয়েনবি একে শিল্প বিপ্লব নামে আখ্যায়িত করেন।

✌✌আরও পড়ুনঃ সমাজকর্মে পেশার ধারণা (Concept of Profession in social work)

 

শিল্প বিপ্লবের সূচনা The beginning of the industrial revolution

শিল্প বিপ্লবের সূচনা The beginning of the industrial revolution

শিল্প বিপ্লবের সূচনা ও ব্যাখ্যায় সমাজকল্যাণ অভিধানে (The Dictionary of Social Welfare) বলা হয়েছে, ‘শিল্প বিপ্লব হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনাদি যার ফলে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কারখানা ব্যবস্থার সূচনা ঘটেছে। The New Encyclopedia Britannica-তে শিল্প বিপ্লব সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘শিল্প বিপ্লব হচ্ছ কৃষিভিত্তিক হস্তশিল্পনির্ভর অর্থনীতি থেকে শিল্প ও যন্ত্রচালিত উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া যা অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে শুরু হয় ।

প্রফেসর লেডি উইলিয়ামস (Professor Lady Williams)-এর মতে, ‘অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ হতে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্রুত উন্নয়ন এবং উৎপাদন ক্ষেত্রে তার ব্যবহারের ফলে মানবজীবনে যে পরিবর্তন এসেছে তাকেই শিল্প বিপ্লব বলা হয়।’

অমিত সেন-এর মতে, ‘ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুরোপুরি গড়ে ওঠেছিল যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে ইতিহাসে তার নাম দেওয়া হয়েছে শিল্প বিপ্লব।’

তাই দেখা যাচ্ছে যে, শিল্প বিপ্লব হচ্ছে কৃষিভিত্তিক, হস্তশিল্পনির্ভর ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদন ও অর্থনীতি থেকে শিল্প ও যন্ত্রচালিত বৃহদায়তন উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া, যা অস্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে শুরু হয় এবং সেখান থেকে বিশ্বের অন্যান্য অংশে বিস্তার লাভ করে। এর ফলে যোগাযোগ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিসহ সমাজের সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিকসহ সকল ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে যার অবদান মানবসভ্যতার ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্ববহ।

আর্থ-সামাজিক জীবনে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব (Impact of Industrial Revolution in Socio-economic Life)

শিল্প বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং চিন্তাধারার জগতে আমূল পরিবর্তন বয়ে এনেছে। এর ফলে বদলে গেছে পৃথিবীর বাহ্যিক চেহারা, জীবন প্রণালিতে এসেছে বিরাট ভিন্নতা। এটি ইতিবাচক ধারায় যেমনি সভ্যতাকে দিয়েছে চরম উৎকর্ষতা তেমনি নেতিবাচক ধারায় সমাজে সৃষ্টি করেছে নানা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যার। নিচে সমাজজীবনে শিল্প বিপ্লবের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবগুলোকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক ধারায় আলোচনা করা হলো-

শিল্প বিপ্লবের অর্থনৈতিক প্রভাব (Economic impact of industrial revolution)

শিল্প বিপ্লবের ফলে যন্ত্রের যে বিপ্লব এসেছে তার সাথে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তিও পরিবর্তিত হয়েছে। অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে উৎপাদন ব্যবস্থাসহ সকল ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্ভব ঘটে। ফলে অর্থনৈতিক বাবস্থায় একটি আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। এই পরিবর্তনের ধারা একদিকে যেমন ইতিবাচক ভূমিকায় উৎকর্ষ সাধন করেছে তেমনি কিছু নেতিবাচক অবস্থারও সৃষ্টি করেছে। নিচে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শিল্প বিপ্লবের প্রভাবকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক ধারায় আলোচনা করা হলো-

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব (Positive impact on economic field)

শিল্প বিপ্লবের পূর্বে উৎপাদন ক্ষেত্রে তেমন কোনো যন্ত্রপাতির ব্যবহার ছিল না। ফলে উৎপাদনের হার ছিল সীমিত। শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপাদন ক্ষেত্রে ব্যাপক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। কুটির শিল্পভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার খালে শক্তি ও প্রযুক্তিচালিত যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। তাছাড়া নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও প্রয়োগে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত হয়। ফলে উৎপাদন কাঠামোতে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়। ভব্লিউ হফম্যান এর মতে, ‘ব্রিটেনের শিল্প উৎপাদন ১৯০ বছরে (শিল্প বিপ্লবকালে) ৭০ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল।’

শিল্প বিপ্লবের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যেও অবাধ নীতির প্রচলন ঘটে। এতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে জনগণকে স্বাধীনভাবে সম্পদ সংগ্রহ এবং তা ব্যবহারের সুযোগ প্রদান করা হয়। ফলে ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি ও মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রচলন ঘটে। বাণিজ্যের এরূপ বহুমাত্রিকরণ অর্থনীতির বিকাশকে দ্রুততর করে। পাশাপাশি শ্রমের গতিশীলতা অর্থাৎ শ্রমিকের স্থানান্তর বা কর্মের পরিবর্তন সহজতর হয় এবং বহুমুখী পেশা ও নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।

অধ্যাপক মায়ার ও বস্তুউইন

এ সম্পর্কে অধ্যাপক মায়ার ও বস্তুউইন বলেন, ‘শিল্প বিপ্লবের সাথে কৃষি ও যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হয়, কর্মসংস্থানের সুযোগ বহুগুণে বৃদ্ধি পায় বলে দ্রুত ব্রিটিশ জনসংখ্যাকে লাভজনক কাজে লাগানো সম্ভব হয়’। শুধু বাণিজ্য বা শ্রমের ক্ষেত্রে নয়, বরং মুদ্রা ও ব্যাংকিং ব্যবস্থাতেও এক বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয় এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য সহজতর হয়। শিল্প বিপ্লবের ফলে স্থাপিত কলকারখানার কাঁচামাল আনা-নেওয়া এবং কারখানা হতে উৎপাদিত দ্রব্য বাজারজাতকরণ এবং উদ্বৃত্ত উৎপাদন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করার জন্য যাতায়াত, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়।

শিল্প বিপ্লবের সবচেয়ে বড় প্রত্যক্ষ ফল হলো শিল্পায়ন ও শহরায়ন। শিল্পক্ষেত্রে পূর্বের স্বল্প পুঁজির ভিত্তিতে স্বল্প পরিসরে উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তে ব্যাপক পুঁজির ভিডিতে ব্যাপক পরিসরে ব্যবসা-বাণিজ্য ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার সূচনা। হয়। আর শিল্পায়নকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শহরায়ন প্রক্রিয়া। শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শহরকেন্দ্রিক সভাতা। যার ফলে মৌলিক ও অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়।

✌✌আরও পড়ুনঃ মৌলিক মানবিক চাহিদা বলতে কী বুঝ

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব (Negative impact on economic field) শিল্প বিপ্লবের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেমন ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হয় তেমনি বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাবও দেখা দিতে শুরু করে। এর প্রভাবে আধুনিক সমাজে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। শিল্প বিপ্লব সমাজের একশ্রেণিকে যেমন দিয়েছে প্রচুর ঐশ্বর্য তেমনি অন্য শ্রেণিতে তৈরি করেছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা। এর ফলে উৎপাদন মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক পেশাগত দুর্ঘটনা ও পেশাগত সংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব নানাবিধ অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করে শিল্প বিপ্লব পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক সময় ছিল যখন প্রতি বছর হাজারে ৩৫ থেকে ৪০ জন শ্রমিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতো।

ক্ষুদ্র শিল্পে ধ্বস

শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে ক্ষুদ্র শিল্পের পরিবর্তে যান্ত্রিক শিল্পের উদ্ভাবন হলে সমাজে বেকারত্বের সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে শ্রম যেহেতু যান্ত্রিক নির্ভরশীলতায় পরিবর্তিত তাই মানবশ্রমিকের প্রয়োজন কমে আসে। এর ফলে সম্পদ বাড়লেও তা পুঁজিপতি আর শিল্পপতি নামক একশ্রেণির ভান্ডারে জমা হতে থাকে, পক্ষান্তরে শ্রমিক শ্রেণি হয় নিঃস্ব। ফলে সমাজে স্বাভাবিকভাবেই ‘have’ এবং ‘have not’ দু’টি শ্রেণির উদ্ভব হয়। এই পুঁজিপতি ও শিল্পপতি শ্রেণি পরোক্ষভাবে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের সুবিধার্থে আইন প্রণয়ন করে সাধারণ মানুষকে শোষণের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। শিল্প বিপ্লবের ফলে আবিষ্কৃত যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতিতে শিশুদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে অনুন্নত রাষ্ট্রসমূহে দারিদ্র্যের কষাঘাতে পিতামাতারা শিশুদেরকে শৈশবেই শিক্ষার পরিবর্তে কাজে নিয়োজিত করতে বাধ্য হয়। তাই শিল্পায়িত অনুন্নত সমাজে শিশুশ্রম মারাত্মক সামাজিক সমস্যার আকার ধারণ করে।

শিল্প বিপ্লবের সামাজিক প্রভাব (Social impact of industrial revolution)

শিল্প বিপ্লব মানবসভ্যতার বিকাশে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা, স্বাধীনতাবোধ, বিজ্ঞানমনস্কতা প্রভৃতি শিল্প বিপ্লবের সামাজিক ফসল। শিল্প বিপ্লব সামাজিক জীবনে যেমন নানা উৎকর্ষতায় সমাজব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে তেমনি সৃষ্টি করেছে নানামুখী সামাজিক সমস্যার। নিচে সামাজিক ক্ষেত্রে শিল্প বিপ্লবের উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক ও নেতিবাচকু প্রভাবগুলো তুলে ধরা হলো-

সামাজিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব (Positive impact on social field)

শিল্প বিপ্লবের প্রত্যক্ষ সামাজিক প্রভাব হলো রাজতন্ত্র প্রথার বিলুপ্তি। অর্থাৎ সনাতন নিয়মানুসারে রাজার ছেলে রাজা আর চাষির ছেলে চাষিই হবে; শিল্প বিপ্লব এ ধারণার আমূল পরিবর্তন সাধন করে উন্নত সমাজকাঠামোর সৃষ্টি করেছে। যেখানে ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে আধুনিক সমাজকাঠামোর ভিত্তি রচিত হয়। এর ফলে সমাজে নতুন শ্রেণিবিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। যেখানে ব্যক্তি তার স্বীয় যোগ্যতা অনুযায়ী জ্ঞান ও সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে সমাজের একটি নির্দিষ্ট স্তরে উন্নীত হতে পারে।

সমাজকর্ম পেশার বিকাশে শিল্প বিপ্লবের ভূমিকা (Role of Industrial Revolution in the Development of Social Work Profession)

শিল্প বিপ্লব মানবসভ্যতায় এনেছে এক আকস্মিক ও ব্যাপক পরিবর্তন যা মানুষকে বস্তুগত ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দিলেও সমাজজীবনে সৃষ্টি করেছে বহুমুখী জটিল সমস্যার। এ ধরনের নানাবিধ সমস্যার সমাধানে ধর্মীয় মূল্যবোধ, দানশীলতা ও মানবতাবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত স্বেচ্ছামূলক কার্যক্রম ব্যর্থ হলে বাস্তবসম্মত ও বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা শুরু হয়। এ বিজ্ঞানভিত্তিক ও বাস্তবসম্মত সেবা কার্যক্রম থেকেই জন্ম হয় আধুনিক পেশাদার সমাজকর্মের। শিল্প বিপ্লবের ফলে সমাজকর্ম পেশার উদ্ভব ও বিকাশে যে পটভূমির সৃষ্টি হয় তাতে সমাজ সৃষ্ট বিভিন্ন জটিল সমস্যার সমাধান দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়।

শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তিগত দিক

শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধন করলেও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার মতো ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি করে। এ ধরনের সমস্যায় জর্জরিত ব্যক্তিরাই সাধারণত সমাজের অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টিতে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই শিল্প বিপ্লবোত্তর সমাজে সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে স্বাভাবিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে। আত্মনির্ভরশীলতার প্রতি গুরুত্বারোপ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। পেশাদার সমাজকর্ম বিশ্বাস করে যে, ব্যক্তি নিজের সমস্যা নিজেই সমাধানের মাধ্যমে পরিবার ও সমাজে ভূমিকা রাখবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে সমাজকর্ম পেশায় নিয়োজিত সমাজকর্মীগণ। শিল্প বিপ্লব পরবর্তী সময়ে প্রযুক্তির বিকাশ এবং নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রভাবে পরিবার কাঠামোর পরিবর্তন, জনসংখ্যা স্থানান্তর, শ্রমিক শোষণ, শিশুশ্রম বৃদ্ধি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, বেকারত্ব, অপরাধপ্রবণতাসহ নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ সকল সমস্যা কার্যকরভাবে মোকাবিলার জন্য অনুভূত হয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের। মূলত এ প্রেক্ষিতে সমাজকর্ম পেশার উদ্ভব ও বিকাশ সাধিত হয়।

শিল্প বিপ্লব পরবর্তী সময়

শিল্প বিপ্লব পরবর্তী সময়ে সমস্যা ছিল বিভিন্ন প্রকৃতির। তাই প্রতিটি সমস্যার বিশ্লেষণপূর্বক এদের সমাধান দেওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় বিভিন্নমুখী সমাধান প্রক্রিয়ার। এর ফলে প্রয়োজন হয় সুসংগঠিত পেশাদার কর্মকাণ্ডের, যার ফলশ্রুতিতে সমাজকর্ম পেশার উদ্ভব ও বিকাশ সাধিত হয়। শিল্প বিপ্লবের ফলে উদ্ভূত বহুমুখী ও জটিল সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে সমাজকর্মীরা উপলব্ধি করেন যে সমস্যা তিন পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করে। প্রথমত, ব্যক্তিগত পর্যায়ে; দ্বিতীয়ত, দলীয় পর্যায়ে এবং তৃতীয়ত, সমষ্টি পর্যায়ে। বাস্তবমুখী ও স্থায়ী সমাধানের জন্য তিন পর্যায়েই সমস্যা মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হয় এবং সমাজকর্মে তিনটি মৌলিক পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়। এগুলো হলো-১ ব্যক্তি সমাজকর্ম ২, দল সমাজকর্ম এবং ৩. সমষ্টি সমাজকর্ম।

তিনটি সহায়ক পদ্ধতি

আবার এ সকল মৌলিক পদ্ধতিসমূহকে সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করার জন্য সমাজকর্ম নিম্নোক্ত তিনটি সহায়ক পদ্ধতি উদ্ভাবন করে, যথা-১. সামাজিক প্রশাসন, ২. সামাজিক গবেষণা এবং ৩. সামাজিক কার্যক্রম। তাছাড়া ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে সমাজকর্ম পেশায় পদ্ধতি প্রয়োগে আরও বাস্তবমুখী পরিবর্তন সাধিত হয়। আধুনিক সময়ে সকল সমস্যার সাথেই যেহেতু ব্যক্তি, দল ও সমষ্টি জড়িত তাই সমস্যার বাস্তবতা ও প্রকৃতি অনুধাবন করে মৌলিক ও সহায়ক পদ্ধতির সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে নতুন আর একটি পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়; যা ‘Integrated method’ বা সমন্বিত পদ্ধতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

শিল্প বিপ্লবের ফলে যেহেতু পেশাদার সমাজকর্মের আবির্ভাব ঘটে সেহেতু এর জন্য প্রয়োজন হয় আধুনিক সমাজকর্ম শিক্ষার। কেননা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যতিরেকে পেশাদারিত্ব অর্জন সম্ভব নয়। সমাজকর্ম পেশার জন্য এই শিক্ষা উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে শুরু হয়। সময়ের বিবর্তনে ১৯৪০ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সমাজকর্ম অনুমোদন লাভ করে এবং পূর্ণাঙ্গ পেশাগত শিক্ষায় উপনীত হয়।

শেষকথা,

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজকর্ম পেশার উদ্ভব ও বিকাশ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শিল্প বিপ্লব পরবর্তী সময়ে সমাজ ব্যবস্থার প্রয়োজনে পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশ সাধিত হয় যা শিল্প বিপ্লবের কতিপয় ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমের ধারাবাহিকতার ফল। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সমাজকর্ম পেশার ইতিহাসে শিল্প বিপ্লব একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

1 thought on “শিল্প বিপ্লব কি? শিল্প বিপ্লব কত সালে সংঘটিত হয় (Industrial Revolution)”

Leave a Reply