সমাজকর্ম, সমাজকর্মের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Aims and Objectives of Social Work)

সমাজকর্মের ছাত্র-ছাত্রীদের আজকের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপুর্ন একটি বিষয় হতে চলেছে কারণ সমাজকর্ম সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলে মূল বিষয় কখোনই আমরা বুঝতে পারবোনা। আজকের টপিক টি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার অনুরোধ রইলো। আর সমাজকর্ম বিষয়ক আরো তথ্য পেতে আমাদের সাথেই যুক্ত থাকুন। আসা করি উপকৃত হবেন আজকের পাঠ্যটির মাধ্যমে। 

মানুষ সমাজে বাস করে। সমাজ হলো মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের এক জটিল রূপ। সমাজের সদস্যদের মধ্যে সর্বদল সামাজিক সম্পর্ক বিদ্যমান এবং সমাজ সদা পরিবর্তনশীল। ফলে সামাজিক সম্পর্কের ধরনেও পরিবর্তন ঘটে। বিশেষ করে শিল্পনির্ভর সমাজে সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনের প্রভাব অধিক। সমাজের মানুষ অনেক সময় গতিশীল এ সামাজিক সম্পর্কের সাথে সামঞ্জস্য অ্যাপনে ব্যর্থ হয়। এর ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় নানা সামাজিক সমস্যার। আর এ সকল সমস্যার সমাধান এবং মানুষকে তার সামাজিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য স্থাপনে সক্ষম করে তোলার জন্যই সমাজকর্মের উদ্ভব ঘটেছে। সমাজকর্মের মূল লক্ষ্য হলো সামাজিক ভূমিকা পালনের জন্যে সমাজের প্রতিটি স্তরের জনগণকে সক্রিয় ও সক্ষম করে তোলা এবং অনুকূল সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করা

জেনে রাখ,

সমাজকর্মের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সামাজিক ভূমিকা পালনের জন্যে সমাজের প্রতিটি স্তরের জনগণকে সক্রিয় ও সক্ষম করে তোলা এবং অনুকূল সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করা।

আর পরুনঃ মৌলিক মানবিক চাহিদা বলতে কী বুঝ

সমাজকর্মের সংজ্ঞা

এ সম্পর্কে এ্যানি এন মিনাহান (Anne N Minahan) বলেন, ‘সমাজকর্মের লক্ষ্য হলো প্রত্যেকের জীবনমান উন্নয়নের সংরক্ষণ বা ত্বরান্বিত করা।’ এক্ষেত্রে সমাজকর্মের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণে ১৯৮১ সালে NASW (National Association of Social Workers) কর্তৃক প্রকাশিত বিষয়গুলোকে প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচনা করা হয়।’ এগুলো হলোঃ

১ জনগণের সমস্যার সমাধান, উপযোজন এবং উন্নয়ন ক্ষমতার উন্নয়ন; (To enhance Problem-solving, coping and developmental capacities.) এ সম্পদ, সেবা ও সুযোগের সাথে মানুষের সংযোগ ঘটানো; (To link People with resources, services and Opportunities.)

৩ কার্যকরী ও মানবীয় সেবা ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করা; ও (To promote effective and human service system.) ৪. সামাজিক নীতির বিকাশ ও উন্নয়ন। (To develop and improve social Policy.)

ওয়ার্নার ডব্লিউ বোয়েম (Warner W Boehm) সমাজকর্মের তিনটি মৌলিক লক্ষ্যের উল্লেখ করেছেন।” এগুলো হলো:

মানুষের মৃত ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা; (Restoration of impaired capacity)

কার্যকর সামাজিক ভূমিকা পালনের জন্য ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পদের সমাবেশ করা; (Provision of individual and social resources.)

এ সামাজিক বিপর্যয় প্রতিরোধ করা। (Prevention of social disfunction.) সার্বিকভাবে বলা যায় যে, সমাজকর্মের লক্ষ্য হলো সমাজজীবন থেকে সকল প্রকার জটিল সমস্যা দূর করে পরিকল্পিত উপায়ে কাঙ্ক্ষিত ও গঠনমূলক সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। এ উদ্দেশ্যে সমাজকর্ম জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে সকল মানুষের ব্যক্তিগত, দলীয় ও সমষ্টিগত সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে। আধুনিক জটিল সমাজে জনগণকে সকল পরিবর্তিত অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য বিধান ও মানুষের সুপ্ত ক্ষমতার বিকাশ সাধন করে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে সমাজকর্ম বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে থাকে। সমাজকর্ম নিজস্ব সম্পদের ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের প্রতি বিশেষ গুরত্বারোপ করে। 

তাই সম্পদের অপচয় রোধ করে সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবস্থার নিশ্চিত করাও সমাজকর্মের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সমাজস্থ প্রতিটি ব্যক্তির সমাজের প্রতি কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে যা সুষ্ঠুভাবে পালন না করলে সমাজে ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়। এরূপ পরিস্থিতিতে ব্যক্তিকে তার সামাজিক ভূমিকা পালনে সক্ষম করে তোলার লক্ষ্যে সমাজকর্ম বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। সমাজকর্ম জনগণের মধ্যে তাদের দায়িত্ব, কতব্য ও অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করে। এই সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ যেন তার অধিকার সম্পর্কে সজাগ থাকে এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি তার ভূমিকা কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে করণীয় কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারে।

সমাজকর্মের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সমাজে পরিকল্পিত ও গঠনমূলক পরিবর্তন আনয়ন করা। সমাজ হতে নানা অবাঞ্ছিত সমস্যা দূর করে কাঙ্খিত পরিবর্তনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে সমাজকর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে সমাজে বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা; যেমন- জনসংখ্যাস্ফীতি, বেকারত্ব, অপরাধ ও কিশোর অপরাধ, মাদকাসক্তি,

নিরক্ষরতা, নারী নির্যাতন, অজ্ঞতা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিহীনতা প্রভৃতি নিরসনে সমাজকর্ম উদ্দেশ্যভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। পাশাপাশি পশ্চাৎপদ ও অসুবিধাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিভিন্ন সমাজকল্যাণ কর্মসূচি পরিচালনা করে থাকে। যার মধ্যে শিশুকল্যাণ, নারীকল্যাণ, শ্রমকল্যাণ, প্রবীণকল্যাণ, অপরাধ ও কিশোর অপরাধ সংশোধন, সামাজিক নিরাপত্তা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, উন্নয়ন কর্মকান্ডে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ, গ্রাম ও শহর উন্নয়ন, পুনর্বাসনমূলক প্রভৃতি কর্মকাণ্ডে সমাজকর্ম নেতৃত্ব সৃষ্টি ও মানব সম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যক্তির সুপ্ত ক্ষমতা ও প্রতিভার বিকাশ সাধনের উদ্দেশ্যে কাজ করে।

এক্ষেত্রে সমাজকর্ম একটি দেশের সমাজকল্যাণমূলক সেবা ও কার্যক্রমে সামাজিক নীতির বিকাশ ও উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। আধুনিক জটিল সমাজে ব্যক্তি বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমস্যার চাপে ক্রমাগত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে, ফলে পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটায় সামাজিক সংহতি ও ঐক্য ব্যাহত হচ্ছে। সমাজকর্ম মানুষের এ পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নেও কাজ করে যাচ্ছে। তাই বলা যায় যে, সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধনই সমাজকর্মের মূল লক্ষ্য। আর এ লক্ষ্য অর্জনে সমাজকর্ম উদ্দেশ্যভিত্তিক বিভিন্ন জনকল্যাণ ও সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। সমাজকর্ম মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নেও কাজ করে যাচ্ছে।

আরও পরুনঃ সমাজকর্মের জনক কে, সমাজকর্মের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন কে?

সমাজকর্মের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: উপসংহার

সমাজকর্মের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: উপসংহার

সমাজকর্ম ব্যক্তি, পরিবার, দল, সম্প্রদায় এবং সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য নিবেদিত একটি পেশা। এর লক্ষ্য হলো মানুষকে তাদের সম্পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে সহায়তা করা এবং তাদের জীবনের মান উন্নত করা।

সমাজকর্মের কিছু প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল:

  • ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কল্যাণে উন্নতি: সমাজকর্মীরা ব্যক্তি এবং পরিবারগুলিকে তাদের সমস্যাগুলি সমাধান করতে, তাদের সম্পর্ক উন্নত করতে এবং তাদের সম্পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে সহায়তা করে।
  • সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতার প্রচার: সমাজকর্মীরা বৈষম্য দূর করতে, সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে।
  • সম্প্রদায় উন্নয়ন: সমাজকর্মীরা সম্প্রদায়গুলিকে তাদের সমস্যাগুলি চিহ্নিত করতে, সমাধান তৈরি করতে এবং তাদের সম্প্রদায়কে আরও বাসযোগ্য করে তুলতে সহায়তা করে।
  • মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি: সমাজকর্মীরা মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের সহায়তা প্রদান করে, তাদের মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে এবং তাদের সম্প্রদায়ে পূর্ণাঙ্গভাবে অংশগ্রহণ করতে সহায়তা করে।
  • মানবাধিকার রক্ষা: সমাজকর্মীরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং সকলের জন্য মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে।

উপসংহারে, সমাজকর্ম একটি জটিল এবং বহুমুখী পেশা যা ব্যক্তি, পরিবার, সম্প্রদায় এবং সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজকর্মীরা বিভিন্ন ধরণের পরিষেবা প্রদান করে এবং বিভিন্ন ধরণের পরিবেশে কাজ করে। তাদের কাজের মাধ্যমে, তারা বিশ্বকে আরও ভালো জায়গা করে তুলতে সাহায্য করে।

মনে রাখবেন: সমাজকর্মের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে। একেক দেশে সমাজকর্ম একেক ভাবে পরিচালিত হয়। যেমন বাংলাদেশে সমাজকর্ম তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়না বললেই চলে। 

Anne N Minahan, “Purpose and Objectives of Social Work Profiraton Jumuary 26, 1981, p-6

Warmer W Boctum, “Objecteurs of the Social Work Curriculum of the Funve Curriculum Stady 1 (New Virk Council Social Work Education, 1959), P-44- উত, “Introsaction at Social Work A Skidmare and St G Thackeray. Prentice Hall Englewood, New Jersey, 1991. P-6

2 thoughts on “সমাজকর্ম, সমাজকর্মের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Aims and Objectives of Social Work)”

Leave a Reply