সমাজকল্যাণের ধারণা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং সম্পর্ক

✌✌Concept, Aims and Objectives and Relationships of Social Welfare

সমাজকল্যাণের ধারণাটি খুবই ব্যাপক ও বিস্তৃত। সমাজকল্যাণ বলতে শুধু দরিদ্র, দুস্থ ও অসহায় জনগোষ্ঠীর তাৎক্ষণিক বস্তুগত সহায়তা দান বা সমাজের কল্যাণে পরিচালিত কিছু সেবাকর্মকে বোঝায় না, বরং বর্তমানে সমাজকল্যাণ বলতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিনির্ভর সুসংগঠিত সাহায্য ও সেবামূলক কার্যক্রমকে বোঝায়। বৃহৎ পরিসরে সমাজের মানুষের কল্যাণার্থে পৃষীত ও পরিচালিত যাবতীয় সেবা কার্যক্রমই হলো সমাজকল্যাণ। সমাজকল্যাণের ধারণায় বিভিন্ন মনীষী ও সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন বিশ্লেষণাত্মক ও তাৎপর্যপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেছেন।

সমাজকর্ম অভিধান (The Social Work Dictionary) প্রদত্ত সংজ্ঞায় বলা হয়েছে– ‘সমাজকল্যাণ হলো একটি দেশের বিভিন্ন কর্মসূচি, সুযোগ-সুবিধা ও সেবার এমন এক ব্যবস্থা, যা জনগণের ঐ সকল সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও চাহিদা পূরণে সহায়তা করে, যেগুলো সমাজে সংরক্ষণের জন্যে মৌলিক বলে বিবেচিত।” সমাজকর্ম অভিধানের সংজ্ঞায় সমাজকল্যাণ প্রত্যয়টিকে একটি সামগ্রিক সেবাব্যবস্থা স্থাপনার নির্দেশক আখ্যায়িত করে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর পুরণের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। এখানে সামাজিক জীবনের পাশাপাশি মানুষের অর্থনৈতিক, শিক্ষাব্যবস্থাসহ সকল দিকের প্রতিও গুরুত্বারোপ করে তা অর্জনের ওপর জোর দেয়া হয়।

আরও সংজ্ঞা জেনে নি,

এনসাইক্লোপেডিয়া অব স্যোশ্যাল ওয়ার্ক (Encyclopedia of Social Work) এ বলা হয়েছে, ‘সমাজকল্যাণকে সম্ভবত সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যায় একটি সুন্দর সমাজের লক্ষ্য হিসেবে, যে সমাজ কর্মসংস্থানের সুযোগ ও মানবসম্পদ উন্নয়নের ব্যবস্থা করে, যা অভাব ও দুর্যোগে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, যা ব্যক্তির মেধা এবং অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা ও স্থিতিশীলতার ওপর ভিত্তি করে সমাজের সমৃদ্ধি ও ক্রমোন্নতিকে ত্বরান্বিত করে।’ এ সংজ্ঞা অনুসারে সমাজকল্যাণকে একটি আদর্শ সমাজের লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কতগুলো নির্দেশককে চিহ্নিত করা হয়েছে যার মধ্যে কর্মসংস্থান ও মানবসম্পদের উন্নয়নে কার্যকর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, ব্যক্তির মেধা ও প্রতিভা, উৎপাদনমুখী স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য। মূলত এ সকল নির্দেশকগুলোর সমন্বিত প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজকল্যাণের প্রকৃত রূপ প্রকাশিত হয়।

সমাজকল্যাণের সবচেয়ে বহুল প্রচলিত এবং সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেছেন ওয়াল্টার আর্থার ফ্রিডল্যান্ডার (W A Friedlander); তার মতে, ‘সমাজকল্যাণ হলো সমাজসেবা ও প্রতিষ্ঠানের এমন একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা যা বাত্তি ও দলকে সন্তোষজনক জীবন ও স্বাস্থ্য এবং ব্যক্তিগত সামাজিক সম্পর্ক লাভে সহায়তা করে যাতে, তারা নিজেদের সুপ্ত ক্ষমতার বিকাশ সাধন এবং পরিবার ও সমাজের প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মঙ্গল নিশ্চিত করতে পারে।” ফ্রিডল্যান্ডারের সংজ্ঞাটিতে সমাজের সার্বিক কল্যাণের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। সমাজকল্যাণকে তিনি শুধু একটি সুসংগঠিত সেবামূলক ব্যবস্থা হিসেবেই বর্ণনা করেন নি বরং এর সাথে সমাজের সার্বিক কল্যাণের উদ্দেশ্য, পরিধি ও কর্মপদ্ধতির প্রক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজকল্যাণ হচ্ছে কতিপয় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নির্ভর এমন একটি সুসংগঠিত সেবা কার্যক্রম যা সমস্যাগ্রস্ত মানুষকে এমনভাবে সহায়তা করে যাতে তারা নিজেদের সামর্থ্য ও সম্পদ সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের সমস্যা নিজেরাই মোকাবেলা করে এবং স্বাভাবিক সামাজিক ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়। 

✌✌আরও পড়ুনঃ সমাজসেবা ও সমাজকর্মের সম্পর্ক কি?

 

সমাজকল্যাণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Aims and Objectives of Soical Welfare)

সমাজকল্যাণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Aims and Objectives of Soical Welfare)

সমাজের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করাই সমাজকল্যাণের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সমাজে বিরাজমান সকল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করে বাঞ্ছিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে আধুনিক সমাজকল্যাণ দৃঢ় প্রত্যয়ী। সমাজকল্যাণের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে গিয়ে ওয়ান্টার এ ফ্রিডল্যান্ডার (Walter A Friedlander) বলেন, ‘সমাজকল্যাণের দক্ষা হলো সমাজের প্রতিটি মানুষের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ, সুস্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মান অর্জন, সকল নাগরিকের সমান অধিকার, সম্ভাব্য সর্বোচ্চ আত্মমর্যাদা এবং অন্যের অধিকার ক্ষুন্ন না করে চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা। ফ্রিডল্যান্ডারের এই উক্তিটি বিশ্লেষণ করলে সমাজকল্যাণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে।

সমাজকল্যাণের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সার্বজনীন কল্যাণ নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের ব্যক্তিগত, দলীয় ও সমষ্টিগত সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে। সমাজজীবন থেকে সকল প্রকার জটিল সমস্যা বিশেষ করে আর্থ-সামাজিক সমস্যা দূর করে পরিকল্পিত উপায়ে বাঞ্ছিত ও গঠনমূলক সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে সমাজকল্যাণ প্রত্যয়ী। শিল্প বিপ্লবোত্তর জটিল সমাজে শিল্পায়ন ও শহরায়নের ফলে যে সৃষ্ট সমস্যা মানবজীবনকে নানা বিরূপ ও অস্বস্তিকর পরিবেশের মুখোমুখি করে তুলেছে তা থেকে উত্তরণে জনগণকে সমাজে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য বিধানে সমাজকল্যাণ বিশেষ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।

সামাজিক উন্নতি ও অগ্রগতির লক্ষ্যে

সমাজকল্যাণ সামাজিক উন্নতি ও অগ্রগতির লক্ষ্যে সমস্যামুক্ত সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করে মানুষকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার প্রয়াস চালায়। পাশাপাশি মানুষকে তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধনে বিশেষভাবে সহযোগিতা করে। সমাজকল্যাণ বিশ্বাস করে যে, সম্পদের অপচয় রোধ করে সীমিত সম্পদের সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব। এ লক্ষ্যে সমাজস্ব প্রতিটি ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য বিশ্লেষণ করে তার সামাজিক ভূমিকা নির্ধারণ ও পালনে সহায়তা করতে সমাজকল্যাণ জনগণকে সচেতন করে তোলে। ফলে প্রতিটি মানুষ তার অধিকার সম্পর্কে সজাগ থাকে এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি কী ভূমিকা রাখা উচিত সে সম্পর্কে তার করণীয় নির্ধারণ করতে পারে।

সমাজের সকল শ্রেণির কল্যাণ সাধন করার জন্য সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সহায়তা অপরিহার্য। এজন্য সমাজকল্যাণ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যেমন- কল্যাণমূলক সংস্থা, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রভৃতির মাধ্যমে সমাজের কল্যাণে প্রয়াস চালায়। বর্তমানে সমাজকল্যাণ শুধু আবেগ বা দানশীলতার মাধ্যমে নয় বরং সমস্যার কার্যকরী ও বাস্তবসম্মত সমাধানে এর বিভিন্ন পদ্ধতিগুলোর যথার্থ প্রয়োগ করে থাকে। প্রতিকার, প্রতিরোধ ও উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে সমাজকল্যাণ বিশেষভাবে সক্রিয়।

✌✌আরও পড়ুনঃ মূল্যবোধের ধারণা | মূল্যবোধ কি? এর বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োজনীয়তা

সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্মের মধ্যে সম্পর্ক (Relationship between Social Welfare and Social Work

সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্ম প্রত্যয় দু’টি ভিন্ন হলেও কার্যত ধারণাগত দিক থেকে এরা সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ প্রত্যয় দু’টির একটি সেবামূলক দৃষ্টিভক্তিল, অন্যটি পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। কিন্তু সমাজ ও মানুষের নানা জটিল সমস্যার সমাধান ও কল্যাণের ক্ষেত্রে উভয়ের পদ্ধতি ও কার্যক্রমগত সম্পর্ক লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণে এদের মধ্যকার সম্পর্কের দিকগুলো নিম্নরূপ-

প্রথমত, সমাজকল্যাণ মানুষের সেবা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িত, যা সুসংগঠিত উপায়ে সেবা কার্যক্রম, নীতি ও আদর্শের প্রকাশ ঘটায়। অনুরূপভাবে সমাজকর্ম গঠনমূলক উপায়ে মানুষকে সেবাদান করে যা একই নীতি ও আদর্শের ধারক ও বাহক।

দ্বিতীয়ত, সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্মের বিশেষ লক্ষ্য হলো সমাজের অসহায় বঞ্চিত ও পশ্চাৎপদ জনগণের সমস্যার সমাধান ও তাদের উন্নয়ন ঘটানো। এ প্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্ম উভয়ই ব্যক্তি ও দলের অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনে কাজ করে থাকে।

তৃতীয়ত, সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্ম উভয়ই প্রাতিষ্ঠানিক সেবায় বিশ্বাস করে। সেবামূলক কার্যক্রমে উভয়ই একই দর্শন, মূল্যবোধ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জারা পরিচালিত। ফলে উভয়ের মধ্যে কার্যক্রমগত ঐক্যের সামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হয়।

চতুর্থত, সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্ম উভয়ই সমস্যার প্রতিকার, প্রতিরোধ এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে বিশ্বাস করে। এদের মূল লক্ষ্য হলো ব্যক্তি ও দলকে আত্মনির্ভরশীলভাবে গড়ে তোলা যাতে তারা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে পারে এবং একজন আত্মনির্ভরশীল ব্যক্তি হিসেবে তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে।

পঞ্চমত, সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্ম উভয়ই বস্তুগত ও অবস্তুগত সম্পদের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করে যা ব্যক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে সমাজের উন্নয়ন সাধন এবং অসম্পূর্ণ উন্নয়নকে সম্পূর্ণ করে।

আধুনিককালে সমাজকল্যাণ কি?

ষষ্ঠত, আধুনিককালে সমাজকল্যাণ বলতে দানশীলতা নির্ভর সনাতন সমাজকল্যাণকে বোঝায় না বরং বিজ্ঞানভিত্তিক সুসংগঠিত সেবাদানের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক কল্যাণকে বোঝায়। আর সমাজকর্ম হচ্ছে সমাজকে সেই গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য হাতিয়ার। এটি একটি পেশা। যার রয়েছে নিজস্ব জ্ঞান, দক্ষতা ও কর্মকৌশল। সুতরাং বলা যায় যে, সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্ম উভয়ই মানুষের জীবনের সামাজিক দিকে পরিব্যপ্ত। নিজস্ব বৈজ্ঞানিক পদাঙ্কঅনুসরণের মাধ্যমে উভয়ই সমাজজীবনের নানাবিধ জটিল ও বহুমুখী সামাজিক সমস্যা বিশ্লেষণ ও সমাধানে কাজ করে থাকে। এদের মধ্যে সম্পর্কের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দিকটি হলো উভয়ই ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞান।

এদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিরাজ করলেও কিছু ক্ষেত্রে পার্থক্য সুস্পষ্ট। সামাজিক জীবনের শুরুতেই অক্ষম, অসহায় ও দরিদ্র মানুষের দারিদ্রা লাঘব করার জন্য সমাজকল্যাণের উৎপত্তি হয়। কিন্তু সমাজকর্মের বিকাশ সাধিত হয় মূলত শির বিপ্লব পরবর্তী সময়ে। মূলত শিল্পায়ন ও শহরায়নের ফলে সৃষ্ট আর্থ-মনো-সামাজিক সমস্যার বৈজ্ঞানিক সমাধানের প্রেক্ষিতে সমাজকর্মের উদ্ভব ঘটে। তাই সমাজকল্যাণে দানশীলতা, মানবপ্রেম, ব্যক্তিগত সদিচ্ছা প্রভৃতির আধিক্য থাকলেও সমাজকর্ম এসব গুণাবলিকে গৌণ বিবেচনা করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিনির্ভর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে সমাজের বিভিন্ন জটিল সমস্যার সমাধান ও সেবামূলক কাজে ব্রতী হয়। এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে সমাজকর্মে পেশাগত মূল্যবোধ ও ব্যবহারিক নীতিমালার সংযোজন ঘটেছে যা সমাজকল্যাণের বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে না

1 thought on “সমাজকল্যাণের ধারণা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং সম্পর্ক”

Leave a Reply