সমাজসেবা ও সমাজকর্মের সম্পর্ক কি?

✌✌(Relationship between Social Service and Social Work)

সমাজসেবা সমাজকল্যাণের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত একটি প্রত্যয়। সমাজসেবার ধারণাটি সমাজকল্যাণের মতোই প্রাচীন। সমাজ সৃষ্টির, শুরু থেকেই এর আবির্ভাব। সনাতন সময়ে দুস্থ ও বিপদগ্রস্তদের সহায়তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা, রাস্তাঘাট নির্মাণ, দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন প্রভৃতি সমাজসেবার অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু শিল্প বিপ্লব পরবর্তী সময়ে সমাজসেবার ধারণায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। শুধু দুস্থ অসহায়দের সহায়তা ও রাস্তাঘাট নির্মাণের মধ্যেই সমাজসেবা কার্যক্রম সীমিত নয়। সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ এবং পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে পরিকল্পিতভাবে সামঞ্জস্য বিধানে মানুষকে সহায়তা করাই সমাজসেবার মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে। বর্তমানে সমাজসেবা অনেকটা সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত। পরিবর্তনশীল এই সমাজজীবনে বহুমুখী ও বিচিত্র সমস্যা সমাধানের প্রেক্ষিতে আধুনিক সমাজকর্ম ও সমাজসেবার উদ্ভব। উভয়ের মাঝে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে এবং উভয়ই একে অপরের পরিপূরক।

সমাজের সামগ্রিক কল্যাণে এ দু’টি বিষয় পরস্পর নির্ভরশীল। সমাজকর্মের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের সমস্যার বাস্তবমুখী সমাধান, সামঞ্জস্য বিধান ও উন্নয়ন ক্ষমতার বিকাশ সাধনের মাধ্যমে সেবা ও সুযোগের সাথে মানুষের সংযোগ ঘটানো। এ ক্ষেত্রে সমাজসেবা মানুষের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধন করে সমস্যা থেকে উত্তরণ এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য বিধানে সহায়তা করে থাকে। সমাজকর্ম ও সমাজসেবা উভয়ই সুসংগঠিতভাবে সমাজের মানুষের সেবাদানের নিমিত্তে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করে। এ দু’টি বিষয়ই ব্যক্তির সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার মূলত আধুনিক সমাজকর্মের বিবর্তনের পেছনে যে সনাতন সমাজকল্যাণের ভূমিকা বিদ্যমান তা সমাজসেবার ভিত্তি মানুষের মানবিকতা ও ধর্মভীরুতা বিষয়গুলোর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।

সুতরাং বলা যায়,

এ সকল অভিন্ন বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক সমাজকর্ম ও সমাজসেবার উৎপত্তি। সমাজকর্ম ও সমাজসেবা উভয়ই আধুনিক পদ্ধতিনির্ভর সেবা কার্যক্রম, তাই প্রায়োগিক দিক থেকে বর্তমানে সমাজসেবায় পেশাদার সমাজকর্মের পদ্ধতিগুলোর যথার্থ প্রয়োগ হচ্ছে।

এছাড়া সমাজকর্ম ও সমাজসেবার মূল লক্ষ্য হলো পশ্চাৎপদ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং তাদেরকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা ও বাস্তবায়নে নিয়োজিত কর্মীদের মধ্যে পেশাগত মূল্যবোধের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে সমাজসেবাকে মানবকল্যাণের জন্য গৃহীত সকল সেবামূলক তৎপরতার সমষ্টি বিবেচনা করায় সমাজকর্মের অন্যতম উপায় হিসেবে সমাজসেবাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাই দেখা যাচ্ছে যে, আধুনিক সমাজকর্ম সমাজসেবার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।

✌✌আরও পড়ুনঃ মূল্যবোধের ধারণা | মূল্যবোধ কি? এর বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োজনীয়তা

সামাজিক নিরাপত্তা ও সমাজকর্মের সম্পর্ক (Relationship between Social Security and Social Work)

সামাজিক নিরাপত্তা ও সমাজকর্মের সম্পর্ক (Relationship between Social Security and Social Work)

পারস্পরিক সাহায্য, সহযোগিতা ও মনোভাব সমাজের সূচনালগ্ন হতেই মানুষের মধ্যে বিরাজমান। এগুলোর ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আধুনিক সময়কালে কল্যাণরাষ্ট্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সামাজিক নিরাপত্তা। বর্তমানে কল্যাণরাষ্ট্রে সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান যেমন রাষ্ট্রীয় কতবা, তেমনি সামাজিক নিরাপত্তা লাভ করাও প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। মূলত শিক্ষিত সমাজের আবির্ভাবই সামাজিক নিরাপজ কর্মসূচির ব্যাপ্তিকে আরও সুসংগঠিত করেছে।

সাধারণত ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে আধুনিক সমাজজীবনে বিভিন্ন বিপর্যয়মূলক পরিস্থিতি যেমন- বৃদ্ধকালীন নির্ভরশীলতা, অসুস্থতা, বেকারত্ব, দৈহিক অক্ষমতা, পেশাগত দুর্ঘটনা, মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতিতে রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গৃহীত অর্থনৈতিক সহায়তামূলক কর্মসূচিকে সামাজিক নিরাপত্তা বলা হয়। সামাজিক নিরাপত্তা মূলত বিপর্যয়কালীন সময়ে মানুষকে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। অবসরপ্রাপ্ত চাকুরিজীবীদের জন্য পেনশন, বিমা, শিশুকল্যাণ ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা প্রভৃতি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।

সামাজিক নিরাপত্তা প্রত্যয় দু’টি

সমাজকর্ম ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রত্যয় দু’টি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সমাজকর্ম আজ যে পেশাদার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তা অনেকটাই সম্ভব হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা প্রবর্তনের কারণেই। মূলত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে সমাজকর্মের আধুনিকতার বীজ রোপিত। সমাজকর্ম ও সামাজিক নিরাপত্তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রায় এক ও অভিন্ন। সমাজকর্মের অন্যতম লক্ষ্য হলো মানুষকে সামাজিক ভূমিকা পালনে সহায়তা করা। সামাজিক নিরাপত্তা তার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণকে সম্ভাব্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে সামাজিক ভূমিকা পালনে উদ্যোগী করে তোলে। সমাজকর্ম যেমন মানুষের প্রয়োজন পূরণ ও সমস্যার সমাধানপূর্বক সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলে তেমনি সামাজিক নিরাপত্তা দরিদ্র ও অসহায় শ্রেণির মৌল-মানবিক চাহিদা পূরণ ও উন্নত জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করে সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে প্রত্যয়ী হয়। সমাজকর্ম মূলত ব্যক্তির বস্তুগত ও অবস্তুগত সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে তাকে আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করে। 

সামাজিক নিরাপত্তা কীভাবে সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে উদ্যোগী হয়?

সামাজিক নিরাপত্তা দরিদ্র ও অসহায় শ্রেণির মৌল মানবিক চাহিদাপূরণ ও উন্নত জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করে সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে প্রত্যয়ী হয় নিরাপত্তা ব্যক্তির সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধন করে মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে প্রগতিশীল সমাজ গঠনে উদ্যোগী হয়। বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যক্তি ও তার পরিবারের জন্য একটি অর্থনৈতিক প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত। সমাজকর্ম ব্যক্তি ও পরিবারকে এই অধিকার ও নিরাপত্তা লাভে বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে। সামাজিক নিরাপত্তার যথার্থ প্রয়োগ ও অনুশীলনের মাধ্যমে সমাজকর্ম সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে একটি সৌহাদ্যমূলক পরিবেশ সৃষ্টিতে একে অপরের সহায়ক ভূমিকায় অবর্তীণ হয়। একটি উন্নত সমাজ গঠনে সমাজকর্ম যে কল্যাণমুখী পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয় সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন কর্মসূচি সেই পদক্ষেপকে যথার্থভাবে রূপায়ণ করে থাকে।

✌✌আরও পড়ুনঃ শিল্প বিপ্লব কি? শিল্প বিপ্লব কত সালে সংঘটিত হয় (Industrial Revolution)

সামাজিক পরিবর্তন ও সমাজকর্মের সম্পর্ক (Relationship between Social Change and Social Work)

পরিবর্তন মূলত একটি অবস্থা থেকে আরেকটি অবস্থায় উপনীত হওয়াকে বোঝায়। সে অর্থে সামাজিক পরিবর্তন হলো সমাজের একটি অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তর। সমাজের এ রূপান্তর কখনও ইতিবাচক কখনও নেতিবাচক ধারায় এবং কখনও ধীরগতিতে আবার কখনও দ্রুত গতিতে হয়ে থাকে। মূলত সামাজিক পরিবর্তন বলতে সামাজিক ব্যবস্থায় স্থায়ী ও অপরিহার্য অংশের পরিবর্তনকে বোঝায়। আবার সমাজ কাঠামোর বা বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তনও সামাজিক পরিবর্তন হিসেবে গণ্য হয়।

পরিবর্তন একটি অবশ্যম্ভাবী বিষয়। পরিবর্তন ছাড়া সমাজের কল্যাণ আশা করা যায় না। কেননা কল্যাণ অর্থই হচ্ছে ইতিবাচক পরিবর্তন। তাই সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে সামাজিক পরিবর্তন একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। একই লক্ষ্যে একটি সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধনে সমাজকর্মও বিশেষভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সমাজের কল্যাণার্থে ইতিবাচক পরিবর্তনে সমাজকর্ম বিশেষ ক্রিয়াশীলতার ভূমিকার অবতীর্ণ।

সামাজিক পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তিত অবস্থার সাথে মানুষকে খাপ খাওয়াতে সমাজকর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, শিল্প বিপ্লবের ফলে সমাজে একটি আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এর ফলে অর্থনৈতিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে যেমন ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে, ঠিক তেমনি সমাজে সৃষ্টি হয়েছে নানা অবাঞ্ছিতকর অবস্থার। বিশেষ করে মানুষের আর্থ-সামাজিক জীবনে সৃষ্টি হয়েছে নানামুখী জটিল সমস্যার। এর ফলশ্রুতিতে সমাজকর্মের সফল প্রয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে যা পেশাদার সমাজকর্ম অনুশীলনে পরিবর্তনকে ইতিবাচক ধারার বিকশিত হতে সাহায্য করে। অন্যদিকে সমাজকর্মের সুষ্ঠু ভূমিকার অভাবে সমাজে নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হতে থাকে। তাই পরিবর্তিত সমাজে মানুষের সামঞ্জস্যতা বিধানে সামাজিক পরিবর্তন ও সমাজকর্ম বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত হয়ে পড়েছে।

শেষকথা,

সাধারণত পরিকল্পিত পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ হতে বিভিন্ন অস্বস্তিকর ও অবাঞ্চিত অবস্থা দূর করা সম্ভব। সমাজকর্মও পরিকল্পিত পরিবর্তনে বিশ্বাসী। সমাজকর্মের মূল লক্ষ্যই হলো সমাজ হতে অবাঞ্ছিত অবস্থা দূর ও তার মোকাবিলা এবং পরিকল্পিত পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে জনগণের সুখ সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। তাই দেখা যাচ্ছে যে, পরিবর্তনই সমাজকর্মের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে দিচ্ছে। পরিকল্পিত পরিবর্তন যেমন সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করে তেমনি অপরিকল্পিত বা নেতিবাচক পরিবর্তন সমাজকর্ম ও সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে। পরিবর্তনের ফলে যে পরিবর্তিত অবস্থার সৃষ্টি হয় সমাজকর্ম তা মোকাবিলায় সদা সচেষ্ট থাকে। সর্বোপরি সমাজকর্মও ইতিবাচক পরিবর্তনে প্রত্যাশী।

1 thought on “সমাজসেবা ও সমাজকর্মের সম্পর্ক কি?”

Leave a Reply