সমাজ বিজ্ঞানের জনক কে? অগাস্ট কোঁৎ (Auguste Comte)

✌✌Who is the father of social science?

প্রিয় পাঠক বন্ধুরা চলুন জেনে নি সমাজ বিজ্ঞানের জনক কে? আজকের আর্টিকেল টি মন দিয়ে সম্পূর্ণ পড়লে বিস্তারিত জানতে পারবেন আশা করি, সমাজ বিজ্ঞানের জনক হিসেবে অগাস্ট কোঁৎ (Auguste Comte) কে বিবেচনা করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই ফরাসি দার্শনিক, নীতিশাস্ত্রবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী ‘পজিটিভিজম‘ নামক দর্শনের প্রবক্তা ছিলেন।

অগাস্ট কোঁৎ (১৮৩০-১৮৪২) সালেতার Cours de philosophie positive” নামক বিখ্যাত বইয়ে ‘সমাজবিজ্ঞান’ (Sociology) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন এবং সমাজকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অধ্যয়ন করার জন্য একটি নতুন শাস্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।

কোঁৎ বিশ্বাস করতেন যে সমাজ একটি জটিল জীবন্ত প্রাণীর মতো, যার নিজস্ব নিয়ম ও কাঠামো রয়েছে। তিনি সমাজের ইতিহাসকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছিলেন:

  • ধর্মীয় পর্যায়: এই পর্যায়ে, মানুষ প্রাকৃতিক ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য দেবতা ও অলৌকিক শক্তির উপর নির্ভর করে।
  • মেটাফিজিক্যাল পর্যায়: এই পর্যায়ে, মানুষ প্রাকৃতিক ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য অমূর্ত ধারণার উপর নির্ভর করে।
  • পজিটিভ পর্যায়: এই পর্যায়ে, মানুষ বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ঘটনা ব্যাখ্যা করে।

কোঁৎ এর ধারণাগুলি সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

তবে, সমাজবিজ্ঞানের জনক হিসেবে কোঁৎ এর অবদান বিতর্কিতও। সমালোচকরা যুক্তি দেন যে তার ধারণাগুলি ইউরোপকেন্দ্রিক এবং পুরুষ-কেন্দ্রিক ছিল এবং তিনি সমাজের জটিলতা ও বৈচিত্র্যের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব:

যদিও কোঁৎ কে সমাজবিজ্ঞানের জনক হিসেবে স্বীকৃত, সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রের বিকাশে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব অবদান রেখেছেন।

  • এমিল ডুরkheim (Émile Durkheim): ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী যিনি ‘কার্যকারিতা’ (functionalism) তত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন।
  • ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber): জার্মান সমাজবিজ্ঞানী যিনি ‘বুঝ’-ভিত্তিক সমাজবিজ্ঞান (verstehende sociology) এর ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন।
  • কারল মার্ক্স (Karl Marx): জার্মান দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী যিনি ‘সংঘাত তত্ত্ব’ (conflict theory) এর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।

সমাজবিজ্ঞানের জনক হিসেবে অগাস্ট কোঁৎ এর অবদান অস্বীকার করা যায় না। তবে, এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে সমাজবিজ্ঞান একটি জটিল ও বহুমুখী ক্ষেত্র যার বিকাশে অনেক ব্যক্তিত্ব অবদান রেখেছে।

✌✌আরও পড়ুনঃ সমাজকল্যাণের ধারণা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং সম্পর্ক

সমাজ বিজ্ঞান কি?

সমাজ বিজ্ঞান হলো মানব সমাজের বৈজ্ঞানিক ও পদ্ধতিগত অধ্যয়ন। এটি সমাজ, মানুষের সামাজিক আচরণ, সামাজিক সম্পর্কের ধরণ, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক দিক এর উপর মনোনিবেশ করে।

সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে সমাজের বিভিন্ন দিক অধ্যয়ন করেন, যার মধ্যে রয়েছে:

  • সমীক্ষা: জরিপ, সাক্ষাৎকার এবং ফোকাস গ্রুপের মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা।
  • পর্যবেক্ষণ: মানুষের আচরণ পর্যবেক্ষণ করা।
  • ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ: অতীতের সমাজ সম্পর্কে তথ্য বিশ্লেষণ করা।
  • আর্কাইভ গবেষণা: ঐতিহাসিক নথিপত্র ও তথ্য বিশ্লেষণ করা।

সমাজবিজ্ঞানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:

  • সংস্কৃতি: বিশ্বাস, মূল্যবোধ, রীতিনীতি, প্রথা এবং জ্ঞান যা একটি সমাজকে সংজ্ঞায়িত করে।
  • সামাজিক গঠন: সমাজের বিভিন্ন স্তর, শ্রেণী এবং গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক।
  • সামাজিক প্রক্রিয়া: সমাজে কীভাবে পরিবর্তন আসে এবং মানুষ কীভাবে একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে।
  • সামাজিক সমস্যা: অপরাধ, দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং পরিবেশগত ক্ষতির মতো সমাজের সম্মুখীন চ্যালেঞ্জগুলি।

সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব:

  • সমাজ সম্পর্কে আমাদের বোঝার উন্নতি: সমাজবিজ্ঞান আমাদের চারপাশের বিশ্বকে আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করে।
  • সামাজিক সমস্যা সমাধানে সহায়তা: সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক সমস্যার কারণগুলি চিহ্নিত করতে এবং সমাধান খুঁজে পেতে তাদের গবেষণা ব্যবহার করতে পারেন।
  • সামাজিক নীতি তৈরি: সরকার এবং নীতি নির্ধারকরা তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণা ব্যবহার করতে পারেন।
  • ব্যক্তিগত জীবন উন্নত করা: সমাজবিজ্ঞান আমাদের নিজেদের এবং আমাদের চারপাশের মানুষকে আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করতে পারে, যা আমাদের আরও সুখী এবং পূর্ণ জীবনযাপন করতে সাহায্য করতে পারে।

সমাজবিজ্ঞান একটি জটিল ও বহুমুখী ক্ষেত্র যা আমাদের চারপাশের বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বোঝার উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে সমাজের বিভিন্ন দিক অধ্যয়ন করেন এবং তাদের গবেষণা সামাজিক সমস্যা সমাধান, সামাজিক নীতি তৈরি এবং ব্যক্তিগত জীবন উন্নত করতে সাহায্য করে।

ম্যাক্স ওয়েবার কে ছিলেন এবং তার অবদান কি ছিল?

ম্যাক্স ওয়েবার (১৮৬৪-১৯২০) ছিলেন একজন জার্মান সমাজবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, আইনবিদ, এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যিনি সমাজবিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞানের বিকাশে একজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি “বুঝ’-ভিত্তিক সমাজবিজ্ঞান” (verstehende sociology) এর ধারণার প্রবক্তা ছিলেন, যার মতে সমাজবিজ্ঞানীদের মানুষের আচরণ ও কর্মের অর্থ বুঝতে হবে।

ওয়েবারের গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • ধর্মের সমাজতত্ত্ব: ওয়েবার ‘দ্য প্রোটেস্ট্যান্ট এথিক অ্যান্ড দ্য স্পিরিট অফ ক্যাপিটালিজম’ (১৯০৫) রচনায় যুক্তি দেন যে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মতত্ত্ব পুঁজিবাদের উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
  • ব্যুরোক্রেসির সমাজতত্ত্ব: ওয়েবার ‘দ্য থিওরি অফ সোশ্যাল অ্যান্ড ইকনোমিক অর্গানাইজেশন’ (১৯২২) রচনায় আধুনিক আমলাতন্ত্রের উত্থান ও প্রভাব বিশ্লেষণ করেন।
  • ক্ষমতার সমাজতত্ত্ব: ওয়েবার ক্ষমতাকে সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে প্রভাব ফেলার ক্ষমতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন এবং বিভিন্ন ধরণের ক্ষমতার ধারণা বিশ্লেষণ করেন।
  • রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব: ওয়েবার ‘পলিটিকস অ্যাজ অ্যা ভোকেশন’ (১৯১৯) রচনায় রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং নেতৃত্বের ভূমিকা পর্যালোচনা করেন।

ওয়েবারের কাজের প্রভাব:

ওয়েবারের কাজ সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস এবং দর্শন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তিনি আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের জনক হিসেবে বিবেচিত হন এবং তার ধারণাগুলি আজও গবেষক, নীতি নির্ধারক এবং সাধারণ মানুষ দ্বারা ব্যবহৃত হয়।

ওয়েবারের কাজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক:

  • ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি: ওয়েবার বিশ্বাস করতেন যে সমাজবিজ্ঞানীদের মানুষের আচরণ ও কর্মের অর্থ বুঝতে হবে। তিনি ‘বুঝ’-ভিত্তিক সমাজবিজ্ঞান’ (verstehende sociology) এর ধারণার প্রবক্তা ছিলেন, যার মতে গবেষকদের অধ্যয়নশীলদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বকে বুঝতে হবে।
  • ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ: ওয়েবার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের উপর জোর দিয়েছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন যে অতীত বর্তমানকে বুঝতে আমাদের সাহায্য করতে পারে।
  • তুলনামূলক পদ্ধতি: ওয়েবার বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতির তুলনা করেছিলেন।

 

✌✌আরও পড়ুনঃ সমাজসেবা ও সমাজকর্মের সম্পর্ক কি?

সমাজবিজ্ঞানে কার্ল মার্ক্স এঁর অবদান কি ব্যাখ্যা করুন?

কারল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) ছিলেন একজন জার্মান দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক এবং বিপ্লবী যিনি সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছিলেন।

মার্ক্সের সমাজবিজ্ঞানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • সংঘাত তত্ত্ব: মার্ক্স বিশ্বাস করতেন যে সমাজ শ্রেণীর মধ্যে সংঘাতের উপর ভিত্তি করে গঠিত, যেখানে শাসক শ্রেণী (বুর্জোয়া) শোষিত শ্রেণী (শ্রমিক শ্রেণী) এর উপর নিয়ন্ত্রণ করে।
  • ঐতিহাসিক বস্তুবাদ: মার্ক্স বিশ্বাস করতেন যে ইতিহাস উৎপাদন পদ্ধতির দ্বারা নির্ধারিত হয়, এবং শ্রেণীর সংগ্রাম সমাজের পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি।
  • অধিশ্রমের মূল্য তত্ত্ব: মার্ক্স বিশ্বাস করতেন যে শ্রমের মূল্যই সমস্ত মূল্যের উৎস, এবং বুর্জোয়া শ্রমিকদের শ্রমের অধিক মূল্য আদায় করে।
  • বিদেশীকরণের ধারণা: মার্ক্স বিশ্বাস করতেন যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা শ্রমিকদের তাদের শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন করে, যার ফলে বিচ্ছিন্নতা ও অসন্তুষ্টি দেখা দেয়।
  • সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যদ্বাণী: মার্ক্স বিশ্বাস করতেন যে পুঁজিবাদ অবশ্যই পতিত হবে এবং তার পরিবর্তে একটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা আসবে যেখানে উৎপাদনের উপায়গুলি সমাজের মালিকানাধীন এবং নিয়ন্ত্রিত হবে।

মার্ক্সের কাজের প্রভাব:

মার্ক্সের কাজ সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস এবং দর্শন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তিনি আধুনিক সমাজতন্ত্রের জনক হিসেবে বিবেচিত হন এবং তার ধারণাগুলি বিশ্বজুড়ে বিপ্লব ও সামাজিক আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছে।

মার্ক্সের কাজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক:

  • বৈজ্ঞানিক সমাজবিজ্ঞান: মার্ক্স বিশ্বাস করতেন যে সমাজবিজ্ঞান একটি বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলা হওয়া উচিত যা সমাজের বস্তুনিষ্ঠ আইনগুলি উন্মোচন করে।
  • সামাজিক সমালোচনা: মার্ক্স পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একজন তীব্র সমালোচক ছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে এটি শোষণ ও বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে গঠিত।
  • ঐতিহাসিক পদ্ধতি: মার্ক্স ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের উপর জোর দিয়েছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন যে অতীত বর্তমানকে বুঝতে আমাদের সাহায্য করতে পারে।

উপসংহার:

আজকের আলোচনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম সমাজবিজ্ঞান কি? এবং কোন কোন বিজ্ঞানি এই সমাজবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে । ধন্যবাদ আমাদের সাথে থাকার জন্য। test

Leave a Reply